দেশ সেরা নির্বাচিত হয়েছে খুলনার মুহাম্মদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ
শ্রী নিত্যানন্দ মহালদার ব্যুরো চীফঃ
বাংলাদেশের ৬৫ হাজার ৬২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়েছে খুলনার মুহাম্মাদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
গত ২৭ জুন ঢাকার ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ সেরা পুরস্কার তুলে দেন মুহাম্মাদ নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান ময়নার হাতে। বিদ্যালয়টি সম্পর্কে একজন গুনিব্যক্তি বলেন,আমার সম্পর্ক প্রায় ১০ বছরের। খুব কাছ থেকে বিদ্যালয়টি এগিয়ে যাওয়া আমি দেখেছি।
কাজের প্রতি ভালোবাসা, পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় থাকলে উপজেলা পর্যায়ের একটি বিদ্যালয় ও কিভাবে দেশসেরা হতে পারে তার উদাহরণ এই মুহাম্মদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অন্য দিকে প্রতিমন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালকের আশ্বাসের পরও ভালো বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ থমকে থাকে তারই উদাহরণ এই বিদ্যালয়। জমি স্বল্পতার কারণে বিদ্যালয়টিতে ভবন তৈরির জায়গা নেই,নেই সুন্দর খেলার মাঠ। পর্যাপ্ত ক্লাস রুমের অভাবে এখনও মেঝেতে মাদুর পেতে পরীক্ষা নেওয়া হয়।
গত ৪ বছর ধরে বিদ্যালয়ের জন্য অল্পকিছু জমি অধিগ্রহণ করতে এমন কোনো কর্মকর্তা নেই যে,তার টেবিলে শিক্ষকরা যাননি। সচিব ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর আশ্বাসেও কাজ হয়নি। এটাই মনে হয় বাংলাদেশ। ২০১৫ সালেই বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী ছিল ৯৮০ জন। বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের মানুষের সন্তান।
প্রথমবার স্কুলে গিয়ে অবাক হলাম,এই ৯৮০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ক্লাস রুম ছিল মাত্র ৪টি। শিক্ষক ছিলো ৯ জন। আর যে ভবনে ক্লাস হচ্ছিলো,যে কোনো সময় তা ভেঙে পড়ার অবস্থায় ছিল।
২০১৫ সালের ১০ মে একটি পত্রিকায় ছবিসহ প্রকাশিত হয় সেই সংবাদ। ওইদিনই পত্রিকার কাটিংয়ের ওপর প্রাথমিক শিক্ষার মহা- পরিচালক নিজ হাতে দ্রুত ব্যবস্থার নেওয়ার নির্দেশ দেন। ওই বছরেই বিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণের যাবতীয় প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৮ সাল নাগাদ ভবনের কাজ শেষ হয়। নতুন ভবনটি এমনভাবে সাজানো হয়েছিল,যাতে শিশুরা একবার বিদ্যালয়ে আসলে আর বাড়ি যেতে চায় না। বিদ্যালয়কে নিয়ে শিক্ষকদের ভাবনা,রুচির প্রকাশ পাওয়া যায় এসব কাজে।
ভবন নির্মাণের পর বিভিন্ন প্রাথমিকের প্রশিক্ষণে জন্য বিদ্যালয়টি পরিদর্শণ করানো হতো। দূর দূরান্ত থেকে বিদ্যালয়টি দেখতে আসতেন শিক্ষকরা। প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিমন্ত্রী,সচিব,মহা- পরিচালকসহ প্রায় সবাই বিদ্যালয় দেখে গেছেন। প্রশংসাও করেছেন। বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১,২৭৬ জন। নতুন ভবন হওয়ার পর বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ হয়েছে ৯টি। অথচ শ্রেণিকক্ষ প্রয়োজন কমপক্ষে ৩০টি। ১:৩৪ অনুপাতে শিক্ষক প্রয়োজন কমপক্ষে ৩৭ জন, রয়েছে মাত্র ১৬ জন।
শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক অল্প থাকায় দুই শিফটে ক্লাস হয়। তাতেও জায়গা হয় না,শিশু শ্রেণির পরীক্ষা হয় বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে। বৃষ্টি হলে মাঝপথে পরীক্ষা বন্ধ রেখেই সবাইকে উঠে যেতে হয়। শিশুদের জন্য খেলার কোনো জায়গা নেই। নেই শহীদ মিনার তৈরির জায়গা।কর্মকর্তারা যারাই পরিদর্শনে যান,ভবন নির্মাণের আশ্বাস দেন। কিন্তু জমি তো নেই। বিদ্যালয়ের জন্য পাশের একটু জমি অধিগ্রহণ করলে বহুতল আরেকটি ভবন নির্মাণ করা যেত। এজন্য গত ৪ বছর ধরে চিঠি চালাচালি ও দৌড়ঝাপ চলছে। জেলা প্রশাসক,অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ), প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে গিয়েছি।
ফোনে মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। অগ্রগতি সামান্য। ২০১৮ সালে নতুন ভবন হওয়ার পর দেখা যায়, সেখানে টয়লেট নেই। বিভিন্ন এনজিও,জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়াশ ব্লকের জন্য ঘুরেও কাজ হয়নি। অথচ অপ্রয়োজনীয় অনেক স্থানে এসব নির্মাণ করা হয়। পরে অবশ্য প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান ময়নার প্রচেষ্টায় ওয়াশ ব্লক ও বাচ্চাদের খাবার পানির ব্যবস্থা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে বিদ্যালয়টির শিক্ষকদের আন্তরিকতা। শহরের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সবার নেতিবাচক ধারণা থাকে। সবাই ভাবেন শিক্ষকরা নিয়মিত পাঠদান করেন না, লেখাপড়ায় গুরুত্ব দেয় না, ইত্যাদি। অথচ এই বিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের মধ্যেও কখনো আন্তরিকতার ঘাটতি পাইনি। নিয়মিত ক্লাসের পাশাপাশি পঞ্চম শ্রেণির দুর্বল শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা ক্লাস হতো। শিক্ষকরাই বিনা পয়সায় নিতেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এটা ভাবা যায় ? এর ফলও পেয়েছেন তারা। পঞ্চম শ্রেণিতে প্রতি বছর বিদ্যালয়টিতে ১৫/২০ জিপিএ-৫, ৮/১০ জন বৃত্তি পেত। সবাই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।
স্কুল পাগল মানুষ হিসেবে দেখেছি প্রধান শিক্ষককে । স্কুলই তার কাছে সব। তার কারণেই স্কুল আজ দেশ সেরা। তার নিজের সন্তানও এই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। প্রাকপ্রাথমিক থেকে পড়ছে। শিক্ষকদের আন্তরিকতা, ভালো কিছু করার অদম্য আগ্রহ এবং ফুলের মতো শিশুগুলোকে দেখে স্কুলটিকে ভালোবেসে ফেলেছি। প্রায় ১০ বছর ধরে স্কুলটির সঙ্গে আছি।
এজন্য অবশ্য মাঝে মাঝে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অনেক সহকর্মী আকারে-ইঙ্গিতে আমার কাছে জানতে চায়, স্কুল নিয়ে এতো রিপোর্ট, দৌড়াদৌড়ির অন্য কোনো কারণ আছে কি-না? টাকা পয়সা অন্য কিছু ?
আমি হেসে ফেলি। আমার উত্তরে তাদের ভাবনার পরিবর্তন হবে না। যা ভাবে, ভাবুক। অবাক হই, বিদ্যালয়টির ভালো দেখে অন্যরা ভালো করার চেষ্টার বদলে অনেকে হিংসাও করে। ফাইল আটকে রাখাসহ কতো কী যে বলে।
এটা আমার সহকর্মীদের মাঝেও দেখেছি। রিপোর্ট করলে ভবন নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণসহ অন্য কাজ দ্রুত হবে-এমন আশায় অনেক সিনিয়র সহকর্মীকেও নিয়ে গেছি। তারাও প্রতিবেদন করেছে। এখন জমি অধিগ্রহণ ফাইল ৪ বছর ধরে আটকে থাকা নিয়ে রিপোর্ট করতে বললে অনেকে রাজি হয় না। অনেকে নিষেধও করে। কী অদ্ভুত মানুষের সাইকোলজি।
এই পদকই দীর্ঘ কষ্ট, বেদনার কিছুটা হলেও অবসান ঘটাবে। দেশ সেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটি সবাইকে শুভেচ্ছা। বিদ্যালয়টি সব শুন্যতা পূরণ হক। সব শিশুর মুখে হাসি ফুটুক।
সবার জন্য শুভ কামনা।
সার্বিক বিষয় আমাদের প্রতিনিধি মহিদুল ইসলাম শাহীন এর সঙ্গে একান্ত আলাপকালে মুহাম্মাদ নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান ময়না বলেন,এই প্রতিষ্টানকে আমি নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করি। সকল ছাত্র ছাত্রীকে নিজের সন্তান মনে করি। যে সকল ছাত্র ছাত্রী ভালো ভাবে পড়াশোনা করবে এবং যে সব শিক্ষক নিয়মিত স্কুলে আসবেন শুধু তারাই আমার আপনজন। সর্বপরি সকলের চেষ্টাতে আজ দেশ সেরা হয়েছি। এজন্য সকলকে ধন্যবাদ। তবে দেশ সেরা পুরস্কারের সাফল্য শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানের নয় বরং খুলনা জেলার সাফল্য।