আজ ভয়াল ২০ মে ! চুকনগর ঐতিহাসিক গণহত্যা দিবস
তুষার কবিরাজ ডুমুরিয়া প্রতিনিধি
আজ ভয়াল ২০ মে ! ঐতিহাসিক চুকনগর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এদিনে বর্বর পাকবাহিনী ও তার দোসররা যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায় তা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ নজির হয়ে রয়েছে। আজ পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের দিন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য এত স্বল্প সময়ে, একই দিনে, একই স্থানে, একই সময়ে এত লোক হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়নি বিশ্বের কোথাও।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে বর্বর পাকবাহিনী ও তার দোসররা বাঙ্গালী জাতির উপর নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে সারাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় ২ মাস পাকবাহিনীর অত্যাচার সহ্য করে অবশেষে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাট, রামপাল, মোড়লগঞ্জ, কচুয়া, শরণখোলা, মোংলা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, চালনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েক লক্ষ মানুষ ভারতে যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে রওনা হয়ে ১৯ মে রাতের মধ্যে সবাই নিরাপদে চুকনগরে এসে পৌঁছায়। খুলনা জেলা সদর থেকে ৩০ কি.মি. দূরে অবস্থিত চুকনগর উপ-শহর। এজন্য বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিশ্রাম ও আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয় চুকনগর শহরকে । ওই দিন রাতে কয়েক হাজার মানুষ চুকনগরের পাতোখোলা বিল, শহরের ভিতর, বটতলা, মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থানে সমবেত হয়। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সবারই মনে চাপা ক্ষোভ ও ভীতি বিরাজ করছে। জন্মভূমি ছেড়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে সবাইকে চলে যেতে হচ্ছে ভারতে। এই অবস্থায় আশ্রয় গ্রহণকারীদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে কখন না জানি পাকবাহিনী তাদের ওপর হামলা করে। এ আশংকায় পরের দিনই চুকনগর শহর ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। কেউ কেউ সকালের দিকে না খেয়ে যাত্রা করে। অন্যরা সকালের খাওয়া দাওয়া শেষে রওনা হবে। এজন্যে সকালে অধিকাংশ পরিবার রান্না-বান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারও রান্না শেষ হয়েছে। কেউবা শুরু করেছে। কেউবা ভাতের থালা নিয়ে খেতে বসেছে। ঠিক এমনই মুহুর্তে পাকবাহিনীর ১টি ট্রাক ও ১টি জীপ চুকনগর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক ধরে মালতিয়া মোড়ের ঝাউতলা নামক স্থানে এসে হঠাৎ থেমে যায়। এ সময় রাস্তার পাশে পাট ক্ষেতে কাজ করছিল চিকন আলী মোড়ল (৭০) নামে এক বৃদ্ধ। গাড়ীর শব্দে সে উঠে দাঁড়ালে পাকবাহিনী তাকেই প্রথমে গুলি করে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় পাকবাহিনীর তান্ডবলীলা।
দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। বেলা প্রায় ১১টা হবে পাকবাহিনী চলে আসে চুকনগর উপশহরে। শুরু হয় গুলি আর গুলি। মূর্হ মূর্হ গুলির শব্দে আর এখানে জড়ো হওয়া নারী পুরুষের আর্ত-চিৎকারে আকাশ, বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। চারিদিকে শুধু কান্নার শব্দ, হুড়োহুড়ি আর দৌঁড়াদৌড়ি। এরপর সবকিছুই এক সময় নীরব হয়ে যায়। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ । পাকিস্তানী নরপশুরা সেদিন চুকনগর শহর, মন্দির, বটতলা সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঢুকে নিরীহ মানুষকে অকাতরে গুলি করে হত্যা করেছে। কোথাও লুকিয়ে ওদের হাত থেকে কেউ রক্ষা পায়নি। চুকনগর সেদিন মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তানীদের এই তান্ডবলীলা প্রায় ২/৩ ঘণ্টা ধরে চলে। ওই স্বল্প সময়ে বর্বর পাক বাহিনী চুকনগরে যেন মানুষ মারার হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল। সেদিন মানুষের আর্তচিৎকার ও দৌঁড়াদৌড়িতে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে কত অবুঝ শিশু মারা গিয়েছিল তার কোন ইয়ত্তা নেই। কত শিশুকে তার মা ফেলে পালিয়েছিল কিন্তু তারাও কেউ বাঁচতে পারেনি। কত শিশু মৃত মায়ের বুকের উপর শুয়ে দুধ পান করতেও দেখা গেছে। সে জানে না তার মা এ পৃথিবীতে আর বেঁচে নেই। আবার দেখা গেছে অসহায় মায়ের কোলে শিশুর লাশ। মাকে হারিয়ে কত শিশু অসহায়ের মত বসে কাঁদতে দেখা গেছে। সেদিন এমনই দৃশ্য ছিল বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান।
পাকিস্তানীদের নারকীয় তান্ডবে চুকনগরের সবুজ মাটি মুহূর্তের মধ্যে লালে লাল হয়ে উঠেছিল। চুকনগরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বুড়িভদ্রা নদী ছিল রক্তস্নাত লাশের বহর। ছিল তাজা রক্তের স্রোত। কোথাও পা দেওয়ার জায়গা ছিলনা। চুকনগর শহরের ওলিতে গলিতে গাছে, নদীতে, ঘরের চালে, খালে বিলে শুধু লাশ আর লাশ। পাকবাহিনীর বর্বর পৈচাশিক হত্যাযজ্ঞের পর চুকনগর শহর শকুন ও কুকুরের দখলে চলে যায় সেদিন। অনেক মৃত প্রায় ব্যক্তিকে নিয়ে টানাটানি করেছিল শকুন আর কুকুর। এই করুণ দৃশ্য কখনও ভুলবার নয়। শত শত বছর ধরে এই হত্যাকান্ডের তথ্য মানুষ স্মৃতিতে রাখবে বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ। সেদিন চুকনগরে কত মানুষ মারা গেছে তার কোন সঠিক হিসাব ছিল না। তবে তখনকার লাশ বহনকারী ২২ জন শ্রমজীবীর অন্যতম সদস্য (চুকনগরের মৃত আব্দুল জব্বার ও শের আলী সরদার) সহ একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছিলেন, আমরা ৪৪শ’ পর্যন্ত গণনা করার পর আর ঠিক করতে পারিনি। তবে ১০/১৫ হাজারের মত নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাক হানাদার বাহিনী। এত অল্প সময়ে এক জায়গাতেই এত লোককে হত্যা করা হয়েছে তার কোন নজির আজও কোথাও বিশ্বের কোন স্থানে পাওয়া যায়নি। চুকনগরের এ নৃশংস ঘৃন্যতম দৃশ্য পৃথিবীর ইতিহাসে সব গণহত্যার চেয়ে বর্বর বলে অনেক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম দিন। এ দিনটি শুধু চুকনগরের জন্য নয় বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়াল ও স্মৃতিবাহী দিন। স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অবিস্মরণীয় দিন, বেদনা বিধূর ও শোকাবহ দিন।
কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য চুকনগর গণহত্যার ঘটনাটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সঠিক স্থান তো দূরের কথা নামটি পর্যন্ত ও স্থান পায়নি। পৃথিবীর এ জঘন্যতম ঘটনাটি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শুধু চুকনগরেই সীমাবদ্ধ ছিল। এটি ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য উদ্যোগ নেন গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও চুকনগর কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম। এরপর চুকনগরের এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডটি ইতিহাসের পাতায় তুলে ধরার জন্য তিনি তৎপরতা শুরু করেন। সেই থেকে প্রতি বছর দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয়।
এদিকে চুকনগর গণহত্যা দিবস উদযাপন উপলক্ষে গণহত্যা'৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম জানান, সকাল ৯ টায় বধ্যভূমিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শহীদদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন, বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ